প্রধান মেনু

একজন অনন্য চাচা ও ভাতিজার পারস্পরিক ভালোবাসার অমর কাহিনী

ইমাম হুসাইন (আ) তাঁর জীবনের শেষ রাতে যখন সঙ্গীদের জানালেন, জালিম ও বলদর্পী খোদাদ্রোহী শত্রুরা শুধু তাঁকেই (ইমামকে) চায় হত্যা করতে। তাঁর কাছ থেকে জোর করে ইয়াজিদের জন্য আনুগত্য আদায় অথবা তাঁকে হত্যা করাই তাঁদের মূল টার্গেট। তাই অন্যরা চাইলে সবাই তাঁকে ত্যাগ করতে পারেন জীবন বাঁচানোর জন্য।

তাঁর একদল ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও সঙ্গী যাদের সংখ্যা ১০০’রও কিছু কম বা সামান্য বেশি ছিল- তাঁদের সবাই যখন সকলেই এক জায়গায় ও এক বাক্যে সুস্পষ্ট ভাষায় তাঁদের নিষ্ঠা ও আনুগত্যের ঘোষণা দিলেন এবং বললেন যে, আমরা কখনো আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো না, তখন সহসাই পট পরিবর্তিত হয়ে গেলো।

ইমাম (আঃ) বললেন, ব্যাপার যখন এই, তখন সকলেই জেনে রাখো যে, আমরা নিহত হতে যাচ্ছি। তখন সকলে বললো, আলহামদুলিল্লাহ-আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করছি যে, তিনি আমাদেরকে এ ধরনের তাওফীক দান করেছেন। এটা আমাদের জন্য এক সুসংবাদ, একটি আনন্দের ব্যাপার।

ইমাম হুসাইনের (আ) মজলিসের এক কোণে একজন কিশোর বসে ছিলেন; বয়স বড় জোর তেরো বছর হবে। এ কিশোরের মনে সংশয়ের উদয় হলোঃ আমিও কি এ নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হবো? যদিও ইমাম বলেছেন ‘তোমরা এখানে যারা আছা তাদের সকলে’,কিন্তু আমি যেহেতু কিশোর ও নাবালেগ, সেহেতু আমার কথা হয়তো বলা হয় নি। কিশোর ইমাম হুসাইনের দিকে ফিরে বললেন: অর্থাৎ,চাচাজান! আমিও কি নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হবো? এ কিশোর ছিলেন হযরত ইমাম হাসানের (আ) পুত্র হযরত কাসেম।

ইতিহাস লিখেছে, এ সময় হযরত ইমাম হুসাইন (আ) স্নেহশীলতার পরিচয় দেন। তিনি প্রথমে জবাব দানে বিরত থাকেন, এরপর কিশোরকে জিজ্ঞেস করেন, ভাতিজা! প্রথমে তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও, এরপর আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দেবো। তুমি বলো, তোমার কাছে মৃত্যু কেমন; মৃত্যুর স্বাদ কী রকম? কিশোর জবাব দিলেন,আমার কাছে মধুর চেয়েও অধিকতর সুমিষ্ট। আপনি যদি বলেন যে, আমি আগামী কাল শহীদ হবো তাহলে আপনি আমাকে সেই সুসংবাদই দিলেন। তখন ইমাম হুসাইন (আঃ) জবাব দিলেন, হ্যাঁ, ভাতিজা! কিন্তু তুমি অত্যন্ত কঠিন কষ্ট ভোগ করার পর শহীদ হবে। কাসেম বললেন: আল্লাহর শুকরিয়া, আল-হামদুলিল্লাহ-আল্লাহর প্রশংসা যে, এ ধরনের ঘটনা ঘটবে।

এবার আপনারা ইমাম হুসাইন (আঃ) এর এ ভূমিকা নিয়ে চিন্তা করে দেখুন যে, পরদিন কী বিস্ময়কর এক বাস্তব কঠিন দৃশ্যের অবতারণা হওয়া সম্ভব! হযরত আলী আকবরের শাহাদাতের পর এই তেরো বছরের কিশোর হযরত ইমাম হাসানের পুত্র ইমাম হুসাইন (আঃ) এর নিকট এগিয়ে এলেন। যেহেতু তিনি ছিলেন নাবালেগ কিশোর, তার শরীরের বৃদ্ধি তখনো সম্পূর্ণ হয় নি, তাই তার শরীরে অস্ত্র ঠিকভাবে খাপ খাচ্ছিলো না;কোমরে ঝুলানো তলোয়ার ভূমি স্পর্শ করে কাত হয়ে ছিলো। আর বর্মও ছিলো বড়, কারণ বর্ম পূর্ণ বয়স্ক পুরুষদের জন্য তৈরি করা হয়েছিলো, কিশোরদের জন্য নয়। টুপি বড়দের মাথার উপযোগী, ছোট বাচ্চাদের উপযোগী নয়। কাসেম বললেন, চাচাজান! এবার আমার পালা। অনুমতি দিন আমি রণাঙ্গনে যাই।

কোনো কোনা বর্ণনায় এসেছে, ইমাম হাসান (আ) যখন শহীদ হন তখন কাসেমের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। সেই থেকে তিনি চাচা হুসাইন (আ)’র ঘরে তাঁরই সান্নিধ্যে থেকে কিশোর বয়স পর্যন্ত বড় হয়েছেন। তাই ভাইয়ের নয়নের মনি ছিল তাঁরও স্নেহের ধন। চাচা কখনও যুদ্ধে যেতে অনুমতি দিবেন না তা জেনে কাসেম ফুপু যাইনাবের শরণাপন্ন হন। ফুপু জানান যে তাঁর চাচার কাছে প্রিয় কিশোর ভাতিজার যুদ্ধ-যাত্রার অনুমতি আদায় করার মত মানসিক অবস্থা তাঁরও (যাইনাবের) নেই। এক পর্যায়ে কাসেম লক্ষ্য করেন তার বাহুতে তাবিজের মত কিছু একটা আছে। কৌতুহল বশে তা খুলে দেখেন যে তাতে রয়েছে ভবিষ্যতের কারবালা যুদ্ধ সম্পর্কে বাবা ইমাম হাসানের ওসিয়ত। তাতে কাসেমকে বলা হয়েছে, তোমার চাচা তোমাকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিবেন না, কিন্তু তুমি মাথা ও ঘাড়  নিচু করে বার বার অনুরোধ করলে শেষ পর্যন্ত তোমার চাচা তোমাকে অনুমতি দেবেন। কাসেম ওই ওসিয়ত চাচা হুসাইনকে দেখালে তিনি খুব কাঁদেন।

এখানে উল্লেখ্য যে,আশুরার দিনে ইমাম হুসাইন (আঃ) এর সঙ্গী সাথীদের কেউই তার কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে রণাঙ্গনে যান নি। প্রত্যেকেই তাঁর কাছে এসে তাকে সালাম করেন এবং এরপর অনুমতি চান; বলেন: ‘‘আস-সালামু ‘আলাইকা ইয়া আবা আবদিল্লাহ। আমাকে অনুমতি দিন।’’

ইমাম হুসাইন (আঃ) সাথে সাথেই কাসেমকে অনুমতি দিলেন না। তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। কাসেম ও তাঁর চাচা পরস্পরকে বুকে চেপে ধরে কাঁদতে লাগলেন। ইতিহাসে লেখা হয়েছে:  অর্থাৎ,অতঃপর তিনি (কাসেম) তাঁর (ইমাম হুসাইনের) হাত ও পা চুম্বন করতে শুরু করলেন। ‘‘মাক্বাতিল’’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে লেখা হয়েছে: ‘‘তাকে যতক্ষণ না অনুমতি দেয়া হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কিশোর তার (ইমাম হোসেনের) হাত ও পা চুম্বন অব্যাহত রাখেন।’’ (মাকতালু খরাযমী,খণ্ড: ২,পৃষ্ঠা: ২৭)

এ ঘটনার অবতারণা কি এ উদ্দেশ্যে হয়নি যাতে ইতিহাস পুরো ঘটনাকে অধিকতর উত্তম রূপে বিচার করতে পারে? কাসেম অনুমতির জন্য পীড়াপীড়ি করেন আর ইমাম হুসাইন (আঃ) অনুমতি দানে বিরত থাকেন। ইমাম মনে মনে চাচ্ছিলেন কাসেমকে অনুমতি দেবন এবং বলবেন,যদি যেতে চাও তো যাও। কিন্তু মুখে সাথে সাথেই অনুমতি দিলেন না। বরং সহসাই তিনি তার বাহুদ্বয় প্রসারিত করে দিলেন এবং বললেন, এসো ভাতিজা! এসো, তোমার সাথে খোদা হাফেযী করি। কাসেম ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর কাঁধের ওপর তাঁর হাত দুটো রাখলেন এবং ইমামও কাসেমের কাঁধের ওপর হাত দুটি রাখলেন। এরপর উভয়ে কাঁদলেন। ইমামের সঙ্গী সাথীরা ও তাঁর আহলে বাইতের সদস্যরা এ হৃদয় বিদারক বিদায়ের দৃশ্য দেখলেন। ইতিহাসে লেখা হয়েছে, উভয়ে এতই ক্রন্দন করলেন যে, উভয়ই অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। এরপর এক সময় তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন এবং কিশোর কাসেম সহসাই তাঁর ঘোড়ায় আরোহণ করলেন।

ইয়াযীদী পক্ষের সেনাপতি ওমর ইবনে সা‘দের সেনাবাহিনীর মধ্যে অবস্থানকারী বর্ণনাকারী বলেন,সহসাই আমরা একটি বালককে দেখলাম ঘোড়ায় চড়ে আমাদের দিকে আসছে যে তার মাথায় ধাতব-টুপির পরিবর্তে একটি পাগড়ী বেধেছে। আর তার পায়ে যোদ্ধার বুট জুতার পরিবর্তে সাধারণ জুতা এবং তার এক পায়ের জুতার ফিতা খোলা ছিলো; আমার স্মৃতি থেকে এটা মুছে যাবে না যে,এটা ছিলো তার বাম পা। তারপর বর্ণনাকারী বলেন: সে যেন চাঁদের একটি টুকরা। (মানাকিবে ইবনে শাহরে আশুব,খণ্ড: ৪,পৃষ্ঠা: ১০৬,এ’লামুল ওয়ারা, পৃষ্ঠা: ২৪২,আল-লুহুফ, পৃষ্ঠা: ৪৮, ইরশাদ-শেখ মুফিদ, পৃষ্ঠা: ২৩৯,মাকতালু মুকাররাম, পৃষ্ঠা: ২৩১,তারীখে তাবারী, খণ্ড: ৬, পৃষ্ঠা: ২৫) একই বর্ণনাকারী আরো বলেন,কাসেম যখন আসছিলো তখনো তার গণ্ড দেশে অশ্রুর ফোটা দেখা যাচ্ছিলো।

সবাই অনুপম সুন্দর এ কিশোর যোদ্ধাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো এবং ভেবে পাচ্ছিলো না যে, এ ছেলেটি কে! তৎকালে রীতি ছিলো এই যে, কোনো যোদ্ধা রণাঙ্গনে আসার পর প্রথমেই নিজের পরিচয় দিতো যে,আমি অমুক ব্যক্ত । উক্ত রীতি অনুযায়ী কাসেম প্রতিপক্ষের সামনে এসে পৌঁছার পর উচ্চস্বরে বললেন:

“যদি না চেনো আমাকে জেনো আমি হাসান তনয় সেই নবী মুস্তাফার নাতি যার ওপর ঈমান আনা হয় ঋণে আবদ্ধ বন্দী সম এই যে হুসাইন প্রিয়জনদের মাঝে,পানি দেয়া হয় নি যাদের উত্তম রীতি মেনে।’’

কাসেম রণাঙ্গনে চলে গেলেন, আর হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ) তার ঘোড়াকে প্রস্তুত করলেন এবং ঘোড়ার লাগাম হাতে নিলেন। মনে হচ্ছিলো যে তিনি তার দায়িত্ব পালনের জন্য যথা সময়ের অপেক্ষা করছিলেন। জানি না তখন হযরত ইমামের মনের অবস্থা কেমন ছিলো। তিনি অপেক্ষমাণ; তিনি কাসেমের কণ্ঠ শোনার জন্য অপেক্ষমাণ। সহসাই কাশেমের কণ্ঠে ‘‘চাচাজান!’’ ধ্বনি উচ্চকিত হলো। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা বুঝতে পারলাম না ইমাম হুসাইন কত দ্রুত গতিতে ঘোড়ায় আরোহণ করলেন এবং রণাঙ্গনের দিকে ছুটে এলেন। তার এ কথা বলার তাৎপর্য এই যে,ইমাম হুসাইন (আঃ) এক শিকারি বায পাখীর মত রণাঙ্গনে পৌঁছে যান।

ইতিহাসে লিখিত আছে,কাসেম যখন ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যান তখন শত্রুপক্ষের প্রায় দুই শত যোদ্ধা তাঁকে ঘিরে ফেলে। তাদের একজন কাশেমের মাথা কেটে ফলেতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তারা যখন দেখলো যে, ইমাম হুসাইন (আঃ) তীব্র গতিতে ঘোড়া চালিয়ে এগিয়ে আসছেন তখন তাদের সকলেই সেখান থেকে পালিয়ে গেলো। আর যে ব্যক্তি কাশেমের মাথা কাটতে চাচ্ছিলো সে তাদেরই ঘোড়ার পায়ের নীচে পিষ্ট হলো। যেহেতু তারা খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সেহেতু তারা তাদের বন্ধুর ওপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে পালিয়ে যায়। অনেক লোক একবারে ঘোড়া চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো;কেউ কারো দিকে তাকাবার অবকাশ পাচ্ছিলো না। মহা কবি ফেরদৌসীর ভাষায়:

‘‘সেই বিশাল প্রান্তরে কঠিন ক্ষুরের ঘায়ে ধরণী যেন হলো ছয় ভাগ আর আসমান আট।’’ কেউ বুঝতে পারলো না যে, কী ঘটে গেলো। ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে সৃষ্ট ধুলার কুণ্ডলী যখন বসে গেলো এবং হাওয়া কিছুটা স্বচ্ছ হলো তখন সবাই দেখতে পেলো যে, ইমাম হুসাইন (আঃ) কাসেমকে কোলে নিয়ে আছেন। আর কাসেম তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো অতিক্রম করছিলেন এবং যন্ত্রণার তীব্রতার কারণে মাটিতে পা আছড়াচ্ছিলেন। এ সময় শোনা গেলো,ইমাম হুসাইন (আঃ) বলছেন: ‘‘আল্লাহর শপথ, এটা তোমার চাচার জন্য কতই না কষ্টকর যে, তুমি তাকে ডাকলে কিন্তু তার জবাব তোমার কোনো কাজে এলো না।’’

(পার্সটুডে থেকে নেয়া )






উত্তর দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*